click on images to know more about the Images
টম ছেলেটি এখনও বালক পর্যায়ে আছে বলা যায়। তার পিতা মাতার সঙ্গে কার্শিয়াং পাহাড়ের মঙ্গলা মন্দিরে মঙ্গলা মায়ের দর্শনে গিয়েছিল। টম খুব ছটপটে ছেলে। তার দুরন্তপনায় আর পাঁচটি বালকের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির বললে অতুক্তি হয় না। সেই দিন কি যেনো একটা মঙ্গলা মায়ের তিথির যোগ ছিল। মন্দিরের ভীতর বাহিরে তিল ধরার জায়গা নেই। বড় ছেলেদের মতো টম কিছুতেই বাবা মার হাত ধরে ঘুরতে ছায়না না। সে সর্বদা স্বাধীন ভাবে একা একা ঘুরার শখ। যেন টম বড়দের মতই স্বাধীন সাবলীল। মা মঙ্গলা দেবীর মন্দিরের ভীতরে ও বাইরে এক জন সমুদ্রে পরিণত হয়েছে। এক সময় টম পিতা মাতার সঙ্গ চ্যুত হয়ে মন্দিরের বাইরের ভীড়ে তলিয়ে গেল। মন্দিরের বাইরে প্রায় মন্দিরের কেন্দ্র স্থল থেকে এক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ভীড়ে ঠাসা এক জনস্রোতে রাস্তা ঘাট কিছুই ঠিক করে চেনার উপায় নাই। টম মন্দির স্থল থেকে যে দিকে যায় সেই দিকিই একই রকম মনে হয়। এক সময় মন্দির থেকে মানুষের ভীড়ের জনস্রোতে মন্দিরের উল্টো দিকটাকে মন্দির দিকে যাচ্ছে বলে মনে হল টমের। সেই রাস্তা দিয়ে টম যেতে গিয়ে সম্পূর্ণ দিক ভোলা হয়ে কার্শিয়াং শহরের এক বহির দিকে গিয়ে এক মেঠো রাস্তায় গিয়ে উঠে। একটি পাহাড়ের তল দেশের রাস্তা পেরিয়েই যেনো সব কিছু পাল্টে গেল। রাস্তার দিকে পাহাড়ের তলদেশে শুধুই ভুট্টার ক্ষেত। প্রচুর কাকের আনাগোনা। কাকা রব যেনো ভুট্টার ক্ষেত্র গুলিকে কাপিয়ে তুলে অস্থীর করে দিয়েছে। এক জায়গাই দেখে একটি মাচার উপর ছোট্ট একটি মলিন মুখের বালিকা বাঁশের ফটফটি বাজিয়ে ক্ষেত থেকে কাক গুলি তাড়ানোর নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। টম গিয়ে বালিকার নিকট উপস্থিত হল। বালিকা, টমের আগমনের কারন জানতে চাইলে বলল যে, " মঙ্গলা মন্দির থেকে পথ ভুলে পাহাড়ের অজানা রাস্তায় হাটতে হাটতে চলে এসেছি এখানেই।" টম বালিকার নাম জানতে চাইলে বালিকা তার নাম বলে ত্যানিয়া। ত্যানিয়াকে জিজ্ঞাসা করে টম, " তুমি স্কুলে যাওনা ? তোমার পিতা মাতায় বা কি করেন ? " কোথায় বা ঘর ? ত্যানিয়া বলে, ঐ কয়েকটি ছোটো বড় পাহাড়ের পরে উচুনিচু আকাঁবাকা পথ পেরিয়ে কয়েকটি চা বাগানের পরে কমলালেবু বাগিচার ধারে আমাদের ঘর। গ্রামের নাম ডাম্বেল। " আরও বলে যে, " পিতা গ্রাম রক্ষির চাকুরী করতো পাহাড়ি জঙ্গিরা তাকে খুন করে। মা এখন মোমো বিক্রি করে কোনোমতে সংসার চালই । এই ভুট্টার ক্ষেত আমাদের সাময়িক আমাদের চাষ করতে দিয়েছেন সরকার থেকে । " টম বলে যে, " তাহলে এই ভুট্টার ক্ষেত কে চাষ করে দেন ? ত্যানিয়া বলে যে, " মা আর আমি বহু কষ্টে বেশ কয়েক দিন ধরে এই পাহাড়ি পাথুরে মাটি কুপিয়ে ভুট্টা লাগাই । সেই সময় মায়ের ও আমার হাতে ফোসকা পড়ে যায়। কিছু দিন মা মোমো তৈরী করতে পারেন না তখন আমাদের কিছু দিন অনাহারে অর্দ্ধাহারে দিন গুজরাতে হয়।" টমের এসব কিছু (4) সংসারের বিষয়ে তেমন কোনো জ্ঞান না থাকলেও কেমন যেন ত্যানিয়াদের কষ্টে খুব দুঃখ পেল । ত্যানিয়া ক্ষেত থেকে একটি কাঁচা দুধেল ভুট্টা ভেঙ্গে টমকে দেয় এবং খোসা ছাড়িয়ে কিভাবে খেতে হয় দেখিয়ে দেয়। টমের প্রায় সারা দিন ধরে পাহাড়ের চড়াই উতরাই আঁকাবাকা পথ অতিক্রম করাই খুব খিদে পায়। ভুট্টার কোঁড়াটি খিদে পেটে খেয়ে খুব সুস্বাদু অনুভব করে এবং তৃপ্তি পায়। টম ত্যানিয়ার বাঁশের চোঙে ঝরনার জল রাখা ছিল পান করে পিপাসা দূর করে খুব আরাম বোধ করে। তাদের মধ্যে এ কথা সে কথা চলতে চলতে সূর্য মামা কখন কখন ঐ বড় পাহাড়ের আড়ালের পাটে চলে যায়। ত্যানিয়া টমকে তাদের বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে টম নির্দ্ধায় রাজি হয়ে যায়। ত্যানিয়া ভাবে টমকে এখন ছেড়ে দিলে এই অবেলায় যাবেই বা কোথায়। টম পাহাড়ের আঁকাবাকা উচুনিচু পথ বেয়ে চলে আর দেখে কোনো কোনো জায়গাই আপেল কমলা লেবুর বাগানের বৃক্ষে বৃক্ষে থরে থরে আপেল ও কমলা লেবু এমন ভাবে ফলেছে যে ফলের ভারে ডাল পালা গুলি নুইয়ে পড়েছে। পাহাড়ি মেয়েরা চা বাগানে মাথায় কেউবা কাপড় বেধে কেউবা মাথায় টোকা দিয়ে পিটে ঝুড়ি বেধে নিয়ে চা পাতা এখনো তুলছে। এখনো কাজে ভঙ্গ দেয় নাই। তারা পাহাড়ি চা শ্রমিক তাই কাজের শেষ চিকেশ থাকতে নিকেশ নেই। ত্যানিয়া এক জায়গাই একটি ছোটো খাটো ঝর্না দেখাল টমকে । রাস্তার ধারে বিভিন্ন নাম না জানা রং বেরং এর পাহাড়ি ফুল ফুটে রয়েছে। গাছের গুড়িতে ডালে বিভিন্ন রকম অর্কিট জাতীয় ফুল ফুটে এক মনরম দৃশ্যে পরিবেশকে এক মন মুগ্ধকর দৃশ্যে পরিণত করেছে। এসব ধীরে ধীরে ভালো করে দেখতে দেখতে টমের রাস্তা এগুতে দেরি হয়ে যায়। ত্যানিয়াকে এটা কি ওটা কি পাহাড়ের হাজারো নাম না জানা অজানা গাছ পালার কথা জিজ্ঞাসা করে করে ত্যানিয়া ব্যস্ত করে তুলে। ত্যানিয়া অবশ্য সব গুলির ব্যাপারে জানে তবে যতটা জানে তা নির্ভুল ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে। তাতে ত্যানিয়া রাগও করে না বিরক্তও হয় না। এই ভাবে যখন ত্যানিয়া ঘরে পৌঁছাই তখন সন্ধা ঘনিয়ে সারা পাহাড় পর্বত শ্রেণি গাঢ় অন্ধকারে ডুবে যায় এবং অঝরে বৃষ্টি নামে। ত্যানিয়াদের ঘরে ঠিক ভাবে বৃষ্টির জল রোধ করতে পারেনা একেতো টিনের চাল মাঝে মাঝে ফুটো তার পরে পাহাড়ের ঝোড়ো বাতাসের ঝাপটাতে অঝরে বৃষ্টির ধারা যেন বাইরের থেকে ঘরে ভিতরেই বেশি জল বর্ষণ হতে থাকে। এক সময় ঝোড়ো বাতাস থেমে পাহাড় শান্ত হয়ে বৃষ্টি বিরাম দেয়। ত্যানিয়ার মা টমকে মোমো আর কিছু পাহাড়ি ফর খেতে দেয় এবং খেতে খেতে টমের পিতা মাতা গ্রামের নাম কিভাবে পথ ভুলেছে জিজ্ঞাসা করে সমস্ত কিছু জানতে পারে। বাড়িতে সমস্ত শুকনো জালান খড়ি বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। একটু রাত হলে বহু কষ্টে পাথর কয়লার আচ ধরিয়ে ধরিয়ে বজ্রার রুটি আর পাহাড়ি বুনো আলু, সশ ও ধুদলের তরকারি করে খেতে দেয় টমকে। ঘরে চাল বাড়ন্ত কি আর করবে। এই দুর্যোগ রাত্রে যদিও দূরে তবুও দোকান খোলা পাবে না নিশ্চিত। পিতা মাতা হারিয়ে যাওয়া পথ ভোলা ফুটফুটে কিন্তু মলিন মুখের চেহারার ছেলেটি দুটো ভাত দিতে না পারায় মায়ের মন বলে কথা খুব আফসোস অনুতাপে মনে মনে খুব কষ্ট পেতে লাগল মনকে যেনো আফসোসের পোকায় অন্তর কুরেকুর খেতে লাগল । যেনো মনের ভিতরে আফসোসেরর তীক্ষ্ণ তীর তীব্রাকারে মাতৃ হৃদয়ে হানতে লাগল। আবার মনে মনে ভাবল কি আর করব একেতো আমরা দরিদ্র তার পর বাধ সেজেছে দুর্যোগ পূর্ণ রাত্রি এই বলেই মনকে প্রবোধ দিল ।
ত্যানিয়ার সঙ্গে অনেক রাত্রি পর্যন্ত পাহাড়ের নদ নদী গাছপালা চায়ের বাগান ঝর্না কমলালেবু আপেল আনারসের সমন্ধে অনেক গল্প হল। এক সময় বালক বালিকা সমতল ও পাহাড়ি দুটি পাখি গাঢ় ঘুমে নিদ্রা মগ্ন হল।
টমের পিতা মাতার ছেলে হারানোর ব্যথা ও কষ্ট অনুভব করে ত্যানিয়ার মাতা সকালে টমের সমস্ত কিছু জানিয়ে থানায় খবর করল।
টম ত্যানিয়ার সঙ্গে পাহাড়ে পাহাড়ে পাহাড়ের রাস্তা ঘাটে ভুট্টার ক্ষেতে বেশ কয়েক দিন ঘুরে ঘুরে মনপ্রাণে আনন্দ উপভোগ করতে লাগল। ত্যানিয়া টম যেনো ভিন্ন নীড়ের দুটি পাখির ছানার নিবিড় সম্পর্ক হয়ে পাহাড় বিভিন্ন বনান্তরে ফলের ফুলের বাগবাগাচায় উড়ন্ত পাখির মত ঘুরে ঘুরে পাহাড়ের রাস্তাঘাট পথময় মনমুগ্ধ করে মুখরিত করে তুলল। সেটা আর সপ্তাহ খানিকের বেশি স্থায়ী হল না। টমের সমন্ধে পিতা মাতার নিখোঁজ ডায়েরির ফলে টমের খোঁজ খবর টমের পিতামাতা পেয়ে গেল এবং ত্যানিয়াদের বাড়ি হাজির হল।
বেশতো আছে টম। টম আর যেতে চায়না। ছোট্ট গ্রাম ডাম্বেল আর এখনকার পাহাড় পর্বত বিভিন্ন ফলের বাগান বনান্তর চায়ের বাগান বিভিন্ন পাখ পাখালির বাঁশির সুর তুলা কূজন যেনো টমকে একেবারেই গিলে খেয়েছে। পাহাড় পর্বত উচুনিচু রাস্তা ঘাট বাগবাগিচার ছায়া স্থল এখন খেলা আর ছুটাছুটির বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে । ত্যানিয়া মায়ের নয়ন জুড়ে নয়ন জলে ভরে যায়। ত্যানিয়া হওয়ার এক বছর পরেই তার পেটে সন্তান চলে আসে। সেটি যখন ত্যনিয়ার বাবাকে পাহাড়ি জঙ্গি দুষ্যরা নির্মম ভাবে হত্যা করে তখন শোকে কাতরে মুহুর্মুহু আছাড় খেয়ে পেটেই সন্তানটি মারা যায়। পরে মরা সন্তান গর্ভপাত হলে সেটি ছেলে ছিল জানা যায়। সেটি এখন টমের বয়সেরই হত । ভাবে আমার যেমন পুত্র হারানো ব্যথা বুকে হুহু করছে তেমন পুত্র হারিয়ে টমের মাতাপিতারও হুহু নিশ্চয় করছে।
টম কোনোমতে ত্যানিয়াকে এবং ভাম্বেল গ্রামের আকাশ বাতাস পাহাড় পর্বত রাস্তায় হরেক ফুলের বাহারি পরিবেশ এবং চা বাগান কমলা উদ্যান ছেড়ে কোনো ভাবেই যেতে চায় না। টমের পিতামাতা পুলিশের ভয় দেখিয়ে অনেক সাধ্য সাধনায় কয়েক দিনের হলেও গাঢ় মাতৃ স্নেহ জন্মে গেছে। ত্যানিয়ার মায়ের টমের প্রতি সমস্ত স্নেহ মায়া মমতা ছিন্ন করে টমকে নিয়ে যেতে প্রস্তুত হয় ।
ত্যানিয়া কিছু বুঝে কিছু না বুঝে মলিন মুখে দুচোখ ভরা জল নিয়ে বলে শুধু বার বার, " আবার এসো ভাই এসো ভাই, টাটা বাই বাই "। সমাপ্ত
বিঃদ্রঃ এই গল্পের কপিটি যে কোনো রকম নকল ও প্রিন্ট করা নিষিদ্ধ।