click on images to know more about the Images

মহাপ্রাণ যোগেন্দ্র নাথ মন্ডল

Author: নির্মলেন্দু বিশ্বাস

        অস্পৃশ্য জনজাতির সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠার মহানায়ক যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ১৯০৪ সালের ২৯ শে জানুয়ারি অবিভক্ত বাংলার বরিশালের গৌরনদী থানার মোস্তারকান্তি গ্রামে দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২৬ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে পাস করেন। ১৯২৬সালে আই.এ,এবং ১৯২৯ সালে বি.এ, এবং ১৯৩৪ সালে কৃতিত্বের সাথে আইন বিভাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি চাকরি না করে স্বাধীন জীবিকার মধ্যে দিয়ে অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশা দূর করাই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন।

 

অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠীর সার্বিক মুক্তি আন্দোলনের উৎসর্গীকৃত প্রাণ বাবাসাহেব আম্বেদকর এবং মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল কর্মক্ষেত্রে একে অন্যের পরিপূরক এবং সহযোদ্ধা ডঃ আম্বেদকর তপশিলি জাতি ও উপজাতির মধ্যে বন্দিত হলেও অনেক ক্ষেত্রেই নিন্দিত হয়েছেন মহাপ্রাণ। অশ্পৃশ্য সমাজের জন্য উৎসর্গীকৃত প্রাণ মহাপ্রাণ মন্ডলের মত মহান জননেতাকে অন্যায় অপবাদে কালিমালিপ্ত করা হয়েছে। তাঁর জীবনের সঠিক মূল্যায়ন এবং সত্য উদ্ঘাটন একান্ত প্রয়োজন।

 

মহামানব গুরুচাঁদ ঠাকুর ছিলেন বাংলার শিক্ষা সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রথম পথিকৃৎ এবং অবিসংবাদী নেতা। 

সমালোচকদের কেউ কেউ বলেন গুরুচাঁদের প্রতি যোগেন্দ্রনাথের অনুরাগের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। গুরুচাঁদের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ আর গোপালগঞ্জেই মহাপ্রাণ মন্ডল প্রথম তপশিলি ফেডারেশন সম্মেলন করেন ১৯৪৩ সালের মে মাসে। তিনি গুরুচাঁদ ঠাকুরের অন্যতম পার্ষদ প্রাক্তন বিধান পরিষদের সদস্য ভীষ্মদেব দাস মহাশয় কে অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি করেন।

তাই তিন বছরের মধ্যে ১৯৪৬ সালের মে মাসের মধ্যে সারা ভারত কে কাঁপিয়ে দিতে পেরেছিলেন এবং বাবাসাহেব কে গণপরিষদে পাঠিয়ে স্বাধীন ভারতবর্ষে আম্বেদকর কে শাসনতন্ত্রের জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। 

 

 গুরুচাঁদ ঠাকুরের অন্যতম মানসপুত্র ছিলেন বরিশালের ভেগাই হালদার। তিনি নানা তীর্থ পর্যটন করেও মনের শান্তি খুঁজে পাননি। গুরুচাঁদের সঙ্গে সাক্ষাতের পর তার নবজন্ম লাভ হয়।তিনি গুরুচাঁদের বাণী শিরোধার্য করে নিজ গ্রাম আগৈলঝাড়া তে ফিরে বাজার সংলগ্ন বটগাছের নিচে পাঠশালা স্থাপন করেন এই পাঠশালাটি এখন বাংলাদেশের অন্যতম হাই স্কুল। সংলগ্ন এলাকায় একটি কলেজও স্থাপন করা হয়েছে।১৯২৬ সালে মতুয়া ভেগাই হালদারের আহ্বানে যে সমাবেশ হয় ঐ সভায় ২২ বছরের ছাত্র নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল সার্বিকভাবে সভাটি সাফল্যমন্ডিত করে তোলেন। যোগেন্দ্রনাথ অসাধারণ বাগ্মিতার পরিচয় দিয়েছিলেন শ্রোতৃবর্গের অনেকেই যোগেন্দ্রনাথের মধ্যে তাঁদের ভবিষ্যৎ নেতা কে খুঁজে পান এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং অধিকার আদায়ের স্বপ্ন দেখতে থাকেন।এই সভা প্রমাণ করে গুরুচাঁদের দর্শনেই যোগেন্দ্রনাথ তাঁর আগামী দিনের কর্মসূচি স্থির করে ফেলেছিলেন। 

 

১৯৩৭ সালে প্রথম সাধারণ নির্বাচনে যোগেন্দ্রনাথ বাকরগঞ্জ উত্তর-পূর্ব আসনের প্রার্থী হন। নবতিপর গুরুচাঁদ ঠাকুর যোগেন্দ্রনাথকে আশীর্বাণী পাঠিয়েছিলেন "এই নির্বাচনী যুদ্ধে তোমাকে জয়লাভ করতেই হব। " ১৯৩৭ সালের ৫ ই ফেব্রুয়ারি যোগেন্দ্রনাথ নির্বাচনে জয়লাভ করেন। খবরটি দ্রুত পৌঁছে গেল গুরুচাঁদের নিকট। গুরুচাঁদ ঠাকুর তাঁর পুত্র-পৌত্রাদির পর কোনো ভরসা রাখতেন না। যোগেন্দ্রনাথ গুরুচাঁদের আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়াতে তিনিই হয়ে উঠলেন গুরুচাঁদের অতি আপনজন এবং যোগ্য উত্তরসূরি। গুরুচাঁদের সামাজিক ও শিক্ষা আন্দোলনে সফল হলেও রাজ ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন অধরাই ছিল যোগেন্দ্রনাথের নির্বাচনে জয়লাভ জীবদ্দশায় রাজ ক্ষমতা দখলের সূচনা দেখতে পেয়ে মাত্র ২২ দিন পরে অতিশয় প্রশান্তিতে তিনি চির নিদ্রামগ্ন হন।

 

 অনেকেই ভেবে থাকেন মহাপ্রাণ মন্ডল কেন মুসলিম লীগের সমর্থনে ১৯৪৬ সালের চৌঠা নভেম্বর কেন্দ্রীয় আইন সভায় আইন মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন? এখানে বলা প্রয়োজন যে ১৯৩০,৩১, এবং ৩২ সালের গোলটেবিল বৈঠকে মুসলিম লীগের তথা জিন্নার সমর্থনে ডঃ আম্বেদকর অস্পৃশ্যদের জন্য সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারার সংরক্ষণের অধিকার পেয়েছিলেন।সেই থেকেই অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে মুসলিম লীগের সাথে অস্পৃশ্যদের রাজনৈতিক আঁতাত চলে আসছে।পূর্বের রাজনৈতিক মর্যাদা দিয়ে যোগেন্দ্রনাথ শর্তসাপেক্ষে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন।ডঃ আম্বেদকর যোগেন্দ্রনাথ এর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগদানে সন্তোষ প্রকাশ করে একটি টেলিগ্রামে জানিয়েছিলে-"You have my blessing" 

 

১৯৩৮সালের ১৩ই মার্চ গুরুচাঁদ ঠাকুরের স্মরণসভা হয় কলকাতার এলবার্ট হলে। সভাপতি সভাপতিত্ব করেন জে.সি.গুপ্ত এবং প্রধান অতিথি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু এই সভার আয়োজক ছিলেন মহাপ্রাণ মণ্ডল। দুঃখের বিষয় ব্রাহ্মণ্যবাদী চক্রান্তে এই খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। ওই সভায় মহাপ্রাণ মন্ডল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে দিয়ে গুরুচাঁদ ঠাকুরকে "মহামানব" উপাধি প্রদান করেন। মহাপ্রাণ ছিলেন প্রকৃত অর্থে গুরুচাঁদ দর্শনের রূপকার  

 

১৯৪৬ সালে মনুবাদী চক্রান্তে ডঃ আম্বেদকরকে গণ পরিষদে পাঠানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। বাবা সাহেবের সামনে সমস্ত পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। তিনি গভীর হতাশায় আক্রান্ত হন।এই সময়ে মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল বাবাসাহেব কে জয়ী করার জন্য বীর বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েন ১৯৪৬সালের ১৮ই জুলাই গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯শে জুলাই ফল প্রকাশ হলে দেখা গেল ফেডারেশনের প্রার্থী ডঃ আম্বেদকর সর্বাপেক্ষা বেশি ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। আম্বেদকর কে ভোট দিয়েছিলেন বরিশালের মহাপ্রাণ মন্ডল, ফরিদপুরের দ্বারিকানাথ বারুরী,টাঙ্গাইলের গয়ানাথ বিশ্বাস,রংপুরের ক্ষেত্র নাথ সিংহ এবং খুলনার মুকুন্দ বিহারী মল্লিক। অসংরক্ষিত সাধারণ আসন থেকে জয় লাভ ভারতবর্ষে ব্যতিক্রমী ঘটনা। এই অত্যাশ্চর্জ ঘটনায় ডঃ আম্বেদকর এবং যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এই দুটি নাম ইতিহাসে চিরকাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। 

 

 শৌর্যবীর্যের অধিকারী মুক্তিসূর্য মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামের ফল এবং বাবা সাহেবের মত বিশ্বজ্ঞানী ও ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তির রচিত মহান সংবিধানের ফলেই ভারতের তপশিলি জাতি এবং উপজাতির মানুষেরা সর্বাংশে না হলেও একটা অংশ উপকৃত হয়েছে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেয়েছে। শিক্ষিত উপকৃত মানুষের অনেকেই প্রভুত শৌর্য-বীর্যের অধিকারী মুক্তি সূর্য যোগেন্দ্রনাথের অবদানের কথা মনে রাখেন নি বরং ভুল বুঝে অপব্যাখ্যার বোঝা বহন করে চলেছে।

 

         আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা উল্লেখ না করলে নয় ১৯৬৫ সালে ভারত সরকার তপশিলি জাতি ও উপজাতির সংক্রান্ত বিষয়ে এক সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে,তার চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন বি.এন.লককুর। এই লকুর কমিটি পশ্চিমবঙ্গ থেকে চারটি সম্প্রদায়কে তপশিলি জাতির তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সুপারিশ করে এই চারটি সম্প্রদায় হল১ নমসশূদ্র ২ রাজবংশী ৩ সাহা(শুড়ি)৪ ধোবা।এই খবর প্রচারিত হওয়ার ফলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে সকলেই যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের শরনাপন্ন হন নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য। যোগেন্দ্রনাথ তখন দেশ ভাগ এবং পরবর্তী ঘটনা ক্রমে বিধ্বস্ত। তপশিলি জাতির চারটি সম্প্রদায়ের উপর এই কুঠারাঘাত তিনি মেনে নিতে পারেননি। তিনি আবার সিংহ গর্জনে প্রস্তুত হলেন। প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে অর্জিত অধিকার ছিনিয়ে আনলেন। চারটি সম্প্রদায়ের অনেকেই এই বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নয়। গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা আন্দোলনের ফলে পূর্ববঙ্গের নমঃশূদ্ররা শিক্ষায় অনেকেএগিয়ে গিয়েছিল। দেশভাগের ফলে তাদের উপর বড় আঘাত নেমে আসে। এই সম্প্রদায় ধীরে ধীরে সংহত হয়েছে তাঁদের মধ্যে একটা পুনর্জাগরণ ঘটেছে এবং শিক্ষা চাকরিতে এগিয়ে চলেছে। এই সম্প্রদায়ের মানুষ যোগেন্দ্রনাথকে যোগ্য মর্যাদা দেয়নি।এই সমাজের একটা অংশ এমনই অকৃতজ্ঞ যে তাঁদের মাথার মণীকে তাঁরা মনে রাখেননি ইতিহাস তাঁদের ক্ষমা করবে না।

 

            নির্মলেন্দু বিশ্বাস।

            রাজপুর (সোনারপুর)