click on images to know more about the Images
দিবাকর কিয়ৎক্ষণ পূর্বে অস্তাচলে গেছে।চারিদিকে তমস গাঢ় হতে গাঢ়তর হচ্ছে।নিবিড় নিশীথের নক্ষত্ররাজি গগনে সদ্য আত্মপ্রকাশের তরে উদ্যত।মিষ্টি,মধুর সমীরে আশেপাশের বৃক্ষসকলের হরিৎ পত্রসমুদয় মাঝে মাঝে দোলা খাচ্ছে।আজ রাস্তাঘাট শুনশান।ময়ূখ রাস্তার ধারে একমনে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে সদ্যউদীয়মান নক্ষত্রখচিত গগনের পানে চেয়ে চেয়ে কিসব ভাবছে!হঠাৎ সে দেখে রাস্তা দিয়ে অফিস হতে মৌমিতা ম্যাডাম গৃহে প্রত্যাগমন করছেন।কাঁধে একটি মামুলি অফিস ব্যাগ,ভীষণ সপ্রতিভ ও বিনয়ী তিনি।তেমন কেতাদুরস্ত ভাবভঙ্গি না হলেও চেহারায় ও চালচলনে একটি আভিজাত্য লক্ষ্যণীয়।
ময়ূখকে দেখে মৌমিতা ম্যাডাম স্মিত হেসে পাশ কাটিয়ে চলে যান।আসলে স্বভাবে তিনি মিতভাষিণী,পেশায় একজন ডব্লিউবিসিএস অফিসার,রাজ্যের ভূমি সংস্কার বিভাগে সদ্য চাকুরিতে নিযুক্ত হয়েছেন।থাকেন ময়ূখদের বাড়ির ঠিক উল্টো দিকের একটি ভাড়া বাড়িতে,সঙ্গে তাঁর স্বামী,পুত্র,শ্বশুর ও শাশুড়ি মাতাও রয়েছেন।
তা যাই হোক ময়ূখের মায়ের সঙ্গে মৌমিতা ম্যাডামের আলাপ হয় এবং সেই আলাপ আরো দূরত্ব অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত আত্মীয়তার পর্যায়ে উন্নীত হয়।ময়ূখের মা খুব প্রাণখোলা মানুষ,কোন অপরিচিত ব্যক্তি দেখলে তিনি নিজে যেচে তাঁর সঙ্গে আলাপ করেন ও তাঁর জন্য তিনি সর্বস্ব দিতে প্রস্তুত থাকেন সর্বদা।
তো মৌমিতা ম্যাডাম পদার্থবিদ্যায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্সি কলেজ হতে মাস্টার্স করার পরে ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত চাকুরিটি পেয়েছেন।চাকুরীসূত্রে তিনি দিনাজপুর এসেছেন,কিন্তু তাঁদের প্রকৃত আবাসস্থল কোলকাতার খড়দহে,রহরা রামকৃষ্ণ মিশনের ঠিক গায়ে।
মৌমিতা ম্যাডাম ময়ূখের মায়ের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকে তাঁকে বিস্মৃত হতে পারেন না,কারণ ময়ূখের মা অত্যন্ত সহজ,সরল ও সদালাপী মহিলা যিনি পরোপকার করতে কোন সময় ক্ষান্ত হন না।তারপরে তিনি খেয়াল করে দেখেন যে মৌমিতা ম্যাডাম অফিস থেকে ফিরে এসে তাঁদের পরিবারের সকলের রান্নাবান্না,অন্যান্য ছোটখাটো কর্মাদি ব্যতীত বাসন মাজা,ঘর পোঁছা ও অন্যান্য আরো ছোটখাটো কাজও বেশ মনোযোগের সহিত করছেন যা দেখে ময়ূখের মা তথা কৌশল্যাদেবী বিমোহিত হয়ে পড়েন।এসব দেখে ময়ূখের মার তাঁর আচার-আচরণ খুব পছন্দ হয়।তিনি মৌমিতা ম্যাডামকে নিজের মেয়ের মতো খুব ভালোবাসেন ও তাঁর প্রতি দরদ নিয়ে মেলামেশা করেন যাতে অতো বড় ডাবলুবিসিএস অফিসারও প্রীত হন ভীষণ।এ ব্যাপারে তাঁর যথেষ্ট আত্মপ্রসাদ বিরাজমান।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো মৌমিতা ম্যাডামের কোন অহংকার নেই।তিনি কোন কাজকেই হীনজ্ঞান করতেন না যা তাঁর মত এত বড় একজন অফিসারের নিকট হতে খানিকটা অপ্রত্যাশিত বলেই ময়ূখদের মনে হতো,কারণ মৌমিতা ম্যাডাম মাঝে মাঝে ময়ূখদের গৃহে যাতায়াত করতেন এবং ময়ূখের মাকে ময়ূখের পড়াশোনায় যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করতেন যা পরবর্তীতে ময়ূখের উচ্চশিক্ষার একটি বৃহৎ প্রেরণাস্বরূপ ছিল।
ধীরে ধীরে মৌমিতা ম্যাডামের বিচিত্র গুণের সমাবেশে তৈরি একটি হৃদয়কে ময়ুখও শ্রদ্ধার চোখে দেখতে শুরু করে ও তাঁদের পরিবারের সকলকেই সে পছন্দ করে ও তাঁদের প্রেরণায় একদা-হৃত আত্মবিশ্বাস সে পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হয় এবং পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষায় ময়ূখ যথেষ্ট সম্মানজনক ফলাফল করে একটি চাকুরি পায়।ময়ূখের উক্ত সাফল্যের সিংহভাগই ছিল মৌমিতা ম্যাডামদের পরিবারের একটা অত্যন্ত ভালো ও সুযোগ্য সমর্থন ও অকৃত্রিম ভালোবাসার একটি উৎপাদ।
ধীরে ধীরে সময়ের চাকা সম্মুখে এগোতে থাকে।মৌমিতা ম্যাডামের ট্রান্সফারের অর্ডার হয় কোলকাতার আশেপাশে।তিনি কর্মসূত্রে কোলকাতায় পদোন্নতি নিয়ে গমন করলেও ময়ূখদের পরিবারের প্রতি তাঁর আত্মত্যাগ,ভালোবাসা ও সমর্থন তিনি যুগিয়ে চলেন এবং একদা উদ্দাম ঝড়ে বিপন্ন একটি পরিবারকে সঠিক দিশার সন্ধান দেন যা ময়ূখের পিতা-মাতা বিস্মৃত হতে পারেন না কখনো।তাঁরা তাঁকে নিজ মেয়ের থেকেও বেশি ভালোবেসে ফেলেন।
মৌমিতা ম্যাডাম দিনাজপুর কখনো আসলে ময়ূখদের বাড়িতে উঠতে ভোলেন না তিনি।এভাবে রক্তের সম্পর্কহীন একটি পরিবারেরও যে কিভাবে ময়ূখদের পরিবারের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কের আত্তীকরণ ঘটে যায় তা স্বচক্ষে না দেখলে অবিশ্বাস্য বলে প্রতিভাত হয় পাড়া-পড়শীদের তথা সকলের নিকট।একটি রক্তের সম্পর্ক-বিরহিত মানুষও যে কতটা স্বার্থত্যাগ,সহায়তা ও ভালোবাসার অপরিমেয় বন্ধন সৃষ্টি করে ফেলতে পারন ময়ূখদের পরিবারের সকলের মননের গোপন কুঠুরিতে তা হৃদয়বানরা অবশ্যই উপলব্ধি করতে সমর্থ হবেন।